ব্যাটারি আবিষ্কারের ইতিহাস: আলোকিত ও বহনযোগ্য বিশ্বের গল্প

 ভূমিকা: ব্যাটারি—আধুনিক জীবনের নীরব চালিকাশক্তি

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাটারি এক অপরিহার্য অংশ। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, রিমোট কন্ট্রোল, এমনকি বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো আধুনিক প্রযুক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার অপরিহার্য। ব্যাটারি হলো এমন একটি ডিভাইস যা রাসায়নিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। কিন্তু এই সহজ-সরল ডিভাইসটির আবিষ্কার কোনো একক ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়, বরং এটি বহু বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকের দীর্ঘ গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সৃজনশীলতার ফসল। চলুন, জেনে নিই কীভাবে ব্যাটারির ইতিহাস শুরু হয়েছিল এবং কীভাবে এটি আজকের আধুনিক রূপ নিয়েছে।


প্রাচীন সূচনা: গ্যালভানির পর্যবেক্ষণ থেকে ভোল্টার বৈপ্লবিক আবিষ্কার

ব্যাটারির ইতিহাসের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় ১৭৮০-এর দশকে ইতালীয় চিকিৎসক লুইজি গ্যালভানি (Luigi Galvani)-এর একটি পর্যবেক্ষণ থেকে। তিনি লক্ষ্য করেন, একটি মৃত ব্যাঙের পেশীতে ধাতব যন্ত্র ছোঁয়ালে সেটি নড়াচড়া করে। গ্যালভানি এই ঘটনাকে "প্রাণী বিদ্যুৎ" (Animal Electricity) বলে অভিহিত করেন। যদিও তার ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক ছিল না, তবে এটি বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিদ্যুতের উৎস নিয়ে গভীর কৌতূহল তৈরি করে।

গ্যালভানির এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হতে পারেননি আরেক ইতালীয় বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা (Alessandro Volta)। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিদ্যুতের উৎস প্রাণীর দেহ নয়, বরং দুটি ভিন্ন ধাতুর মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া। এই ধারণা প্রমাণ করতে তিনি দীর্ঘ গবেষণা করেন এবং ১৮০০ সালে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন। তিনি তৈরি করেন "ভোল্টাইক পাইল" (Voltaic Pile)—যা ছিল মানবজাতির তৈরি প্রথম কার্যকর ব্যাটারি। এটি ছিল দস্তা ও তামার পাত এবং লবণ পানিতে ভেজানো কাপড় বা পিচবোর্ড স্তরে স্তরে সাজিয়ে বানানো একটি যন্ত্র। ভোল্টাইক পাইল ধারাবাহিক বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি করতে পারত। তার এই আবিষ্কারের সম্মানেই আজকের বৈদ্যুতিক বিভবের একককে ভোল্ট (Volt) বলা হয়।

স্থায়িত্ব এবং নিরাপত্তা: ড্যানিয়েল সেল ও শুকনো কোষের উদ্ভাবন

ভোল্টাইক পাইল একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি খুব বেশি স্থিতিশীল ছিল না এবং এর বিদ্যুৎ প্রবাহ ধীরে ধীরে কমে আসত। এই সমস্যার সমাধান করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন ফ্রেডরিক ড্যানিয়েল (John Frederic Daniell)। ১৮৩৬ সালে তিনি একটি উন্নত ব্যাটারি আবিষ্কার করেন, যা ড্যানিয়েল সেল নামে পরিচিত। এতে দস্তা এবং তামার জন্য আলাদা চেম্বার ব্যবহার করা হয়, যা ভোল্টার ব্যাটারির তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করত।

এরপর আসে বহনযোগ্যতার চ্যালেঞ্জ। প্রথম দিকের ব্যাটারিগুলোতে তরল ইলেকট্রোলাইট ব্যবহার করা হতো, যা পরিবহন করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এই সমস্যার সমাধান করেন জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল গ্যাসনার (Carl Gassner)। ১৮৮৬ সালে তিনি প্রথম কার্যকরী শুকনো কোষ (Dry Cell) আবিষ্কার করেন। এতে তরল ইলেকট্রোলাইটের পরিবর্তে পেস্ট ব্যবহার করা হয়, যা ব্যাটারিকে নিরাপদ ও সহজে বহনযোগ্য করে তোলে। এর ফলে টর্চলাইট, পোর্টেবল রেডিও এবং খেলনার মতো হাতে বহনযোগ্য যন্ত্রে ব্যাটারির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।

পুনর্ব্যবহারের ধারণা: রিচার্জেবল ব্যাটারির জন্ম

১৮৫৯ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী গ্যাস্টন প্লান্টে (Gaston Planté) বিদ্যুতের জগতে আরও একটি বিপ্লব ঘটান। তিনি বিশ্বের প্রথম রিচার্জেবল ব্যাটারি তৈরি করেন। এটি ছিল সীসা-অ্যাসিড ব্যাটারি (Lead-acid battery), যা একবার ডিসচার্জ হওয়ার পর আবার চার্জ করে বারবার ব্যবহার করা যেত। প্লান্টের এই আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে আজও গাড়ির ব্যাটারি এবং বিদ্যুৎ সংরক্ষণের বড় বড় সিস্টেমে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।

আধুনিক ব্যাটারির দিকে অগ্রযাত্রা

১৯শ শতকের শেষভাগ এবং ২০শ শতকে বিভিন্ন ধরনের নতুন ব্যাটারি তৈরি হয়, যা ছিল আরও শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:

  1. নিকেল-ক্যাডমিয়াম (Ni-Cd) ব্যাটারি: ১৯০০ সালের দিকে আবিষ্কৃত এই ব্যাটারিগুলো ছিল রিচার্জেবল এবং শক্তিশালী।

  2. নিকেল-মেটাল হাইড্রাইড (Ni-MH) ব্যাটারি: এটি Ni-Cd ব্যাটারির একটি উন্নত সংস্করণ, যা পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর।

  3. অ্যালকালাইন ব্যাটারি (Alkaline Battery): এটি ছিল এক ধরনের ডিসপোজেবল ব্যাটারি যা কম খরচে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারত।

তবে, আধুনিক প্রযুক্তির প্রকৃত বিপ্লব আসে যখন বিজ্ঞানীরা একটি আরও হালকা, শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির আবির্ভাব: আজকের প্রযুক্তির চালিকাশক্তি

১৯৮৫ সালে জাপানি রসায়নবিদ আকিরা ইয়োশিনো (Akira Yoshino) প্রথম কার্যকর লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি (Lithium-ion Battery) তৈরি করেন। এই প্রযুক্তি ছিল হালকা, অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বহুবার চার্জ করা যেত। এর ফলে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এবং ডিজিটাল ক্যামেরার মতো পোর্টেবল ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বর্তমানে বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং সোলার এনার্জি সংরক্ষণের মতো বড় বড় সিস্টেমেও এই ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি আবিষ্কারের অবদানের জন্য আকিরা ইয়োশিনো, জন গুডেনাফ এবং স্ট্যানলি হুইটিংহাম ২০১৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

উপসংহার

ব্যাটারি আবিষ্কারের ইতিহাস হলো এক দীর্ঘ এবং অসাধারণ বৈজ্ঞানিক যাত্রা। গ্যালভানির "প্রাণী বিদ্যুৎ" পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে ভোল্টার ভোল্টাইক পাইল, ড্যানিয়েলের স্থিতিশীল সেল, প্লান্টের রিচার্জেবল ব্যাটারি, গ্যাসনারের শুকনো কোষ এবং অবশেষে আধুনিক লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি পর্যন্ত—প্রতিটি আবিষ্কারই মানব সভ্যতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

ব্যাটারি শুধু আমাদের জীবনকে আলোকিত বা সহজ করেনি, বরং এটি আমাদের জীবনযাত্রা, প্রযুক্তি এবং শিল্পকে আমূল পরিবর্তন করেছে। ব্যাটারি ছাড়া আধুনিক সভ্যতা কল্পনাই করা যায় না। এটি শুধু একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নয়, বরং মানবজাতির নিরন্তর উদ্ভাবনী চেতনার এক দারুণ উদাহরণ।

কোন মন্তব্য নেই

5ugarless থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.